ইয়ংজু ভ্রমণ – Buseoksa Temple, Sobaeksan National Park Nature Center, Sosuseowon Confucian Academy, Yeongju Seobbichon Village

পোস্ট করা হয়েছে: অক্টোবর ১৫, ২০২২
লেখকঃ জুলহাস সুজন


আমরা জানি যে, বৌদ্ধধর্ম মূলত চালু হয়েছে ক্রিস্টপূর্বের ৫০০ বছর আগে অর্থাৎ এখন থেকে ২৫০০ বছর পূর্বে ইন্ডিয়াতে। পরবর্তীতে এই ধর্ম দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পরে। অহিসংস মতবাদ ও পুনর্জন্ম এ বিশ্বাসী ধর্মটি অতন্ত্য জনপ্রিয়তা পায় এবং এটি প্রধানত ২টি দলে বিভক্ত যথা: মহায়ানা ও থেরেবাদা। তবে দক্ষিণ কোরিয়া এবং এর আশেপাশের দেশ গুলোতে মাহায়ানা মতাদর্শ পালন করা হয়।

চুতর্থ শতাব্দীতে চীন থেকে প্রথম কোরিয়ান উপদ্বীপে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে, সে সময় দেশটি পেকচে (Paekche), কোগুরিও (Koguryŏ) এবং সিলা (Silla) এই তিনটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধধর্ম প্রথমে কোগুরিয়র উত্তর রাজ্যে আসে এবং তারপর ধীরে ধীরে অন্য দুটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মানব বিপর্যয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কোরিয়া বিভক্তি শুরু হয়। অগাস্ট ১০-১৭, ১৯৪৫ সালে উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া নাম পৃথিবীর মানচিত্রে দুটি নতুন দেশ তৈরী হয়। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর কোরিয়াকে এবং আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন দিয়েছিলো এবং এই ভূমি সমূহ বিশ্বযুদ্ধে দুই পরাশক্তির ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। গত ৭০ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়াকে আমেরিকা সব ধরণের সামরিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। তবে আমেরিকার সার্বিক সহায়তায় এবং কোরীয়দের একনিষ্ঠ কর্মের ফলাফল হচ্ছে আজকের ১০ম অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়া।

দক্ষিণ কোরিয়াকে ১৭টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬টি মেট্রোপলিটন শহর, ১টি স্পেশাল, ১টি সেলফ-গভর্নিং শহর, এবং ৯টি প্রভিন্সেস রয়েছে। এর মধ্যে ইয়েংজু, উত্তর গেয়ংসাং প্রদেশে অবস্থিত একটি চমৎকার শহর। যাঁরা কোরিয়াতে থাকেন বা খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন যে সমগ্র কোরিয়াতে বৌদ্ধধর্মের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। গত ১৫-১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, এই শহরটি ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছি এবং কিছু নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়েছে। আজকের এই আর্টিকেলে আপনাদের সাথে ইয়েংজু শহরের ভ্রমণ কাহিনী শেয়ার করছি:

১) যেভাবে ভ্রমণের সুযোগটি পেলাম: দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্প, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় ফানডে কোরিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই ভ্রমণের আয়োজন করেন। ইতোপূর্বে ফানডে কোরিয়ার মাধ্যমে আরো কয়েকটি প্রসিধ্য স্থান ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। এক রাত ও ২ দিনের এই সফরে আমার যাতায়াত, রাতে থাকা, প্রতি বেলা খাবার সহ সমুদয় খরচ তারা বহন করেছেন। আমি যেহেতু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করি, সেই সুবাদে এখানে আমাদের এই সুযোগটুকু দেওয়া হয়।

yeongju Confucian Academy


২) ফানডে কোরিয়া নেটওয়ার্ক: একটি চমৎকার প্রতিষ্ঠান যারা দারুনভাবে এই প্রোগ্রাম গুলো নিয়মিত আয়োজন করে চলছেন। তাদের প্রশংসা না করলেই নয়। বিস্তারিত জানতে তাদের ওয়েবসাইট ভিসিট করুন: https://fundaykorea.com

৩) সোল্ শহর থেকে দুরুত্ব: ১৬৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইয়েংজু শহরের উদ্দেশ্যে আমরা সকাল ৭:৩০ মিনিটে যাত্রা শুরু করি এবং তিন ঘন্টা অতিক্রম করে ১০:৩০ মিনিটে সেখানে পৌঁছায়।

৪) UNCESCO হেরিটেজ টেম্পল: ৪ জুলাই ২০১৮ সালে, ৭তম এবং ৯ম শতাব্দীতে তৈরী ৭টি বিখ্যাত মন্দিরকে UNCESCO ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। মন্দির গুলো যথাক্রমে: Tongdosa (৭ম শতকে তৈরী), Buseoksa (৭ম), Bongjeongsa (৭ম), Beopjusa (৮ম), Magoksa (৯ম), Seonamsa (৯ম), এবং Daeheungsa(৯ম)।

yeongju Confucian Academy


৫) আমরা যেখানে ছিলাম: Sobaeksan National Park Nature Center এ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এতো চমৎকার একটি জায়গায় রাতে থাকতে পারাটা কিছুটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তিনদিকে উঁচু পর্বতে ঘেরা, সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ এবং কিছুটা জলপ্রপাত, দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তীর্ণ জলাভূমি, উত্তরদিকে আপেলের বাগান এবং পশ্চিম দিকে এই সেন্টার কর্তৃক তৈরী বাগান যা না দেখলে বা থাকলে সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা যাবে না। এখানে খাবারের জন্য ক্যান্টিন, ইলেট্রিক ফুয়েল ট্যাংক, জিম, ম্যাসাজ সেন্টার, প্লে গ্রাউন্ড, মিউজিক গ্রাউন্ড, লাইব্রেরি, ফটো গ্যালারি বা কি নেই।

yeongju Confucian Academy


৬) চিত্রাঙ্কন: এখানে প্রথমে আমাদের জন্য একটি ড্রয়িং সেশনের আয়োজন করা হয়েছিল, যা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এখানে বৌদ্ধধর্মের উপর কিছুটা আলোকপাত করা হয়, এবং একই সাথে এখানে বৌদ্ধ ঘন্টা কিভাবে বানানো হয় সেটিও দেখানো হয়েছে এবং আমাদেরকে উপহার হিসাবে সেটি দেওয়া হয়েছে। এই পর্বটি শেষ করে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আমরা মূল প্রোগ্রামে যুক্ত হয়েছি।

yeongju Confucian Academy


৭) Buseoksa টেম্পল: ৬৭৬ সালে মাস্টার উইসাং, সিলা রাজ্যে এই টেম্পলটি স্থাপন করেন। মাস্টার উইসাং যখন তাং রাজবংশে অধ্যয়ন করছিলেন, তখন তিনি চীনা সম্রাট গাওজং কর্তৃক সিলা আক্রমণের কথা শুনেছিলেন। তিনি এই খবরটি সিলার রাজা মুনমুর কাছে পৌঁছে দেন। বুসেওকসা নামটি কিংবদন্তি থেকে নেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয় যে মুরিয়াংসুজিয়নের পশ্চিম দিকে অবস্থিত একটি বড় শিলা, বুসেওকসা মন্দিরের মূল হলটি অন্য একটি পাথরের উপরে ভাসছিল। গোরিও রাজবংশের সময় মন্দিরটির নাম ছিল সেওন্ডালসা।

yeongju Confucian Academy


মাস্টার উইসাং এর একটি দারুন প্রেম কাহিনী আছে, যা কোরিয়াতে প্রসিধ্য লোককথা। কোরিয়ান লোককাহিনী এভাবে বর্ণনা করে যে, যখন তিনি অল্পবয়সী ছিলেন, তখন উইসাং একটি সুন্দরী মেয়ে মায়ো হাওয়া ("উপসুন্দর ফুল") এর প্রেমে পড়েছিলেন কিন্তু সিলার রাজা তাকে চীনা সম্রাটের কাছে একটি উপহার হিসেবে পাঠানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন এবং এইভাবে ব্যর্থ হয়েছিল তাদের সম্পর্ক, এটি উইসাংকে ধর্মীয় জীবনে পরিণত করে এবং তিনি সন্ন্যাসী হন। মিয়ো হাওয়া হতাশাগ্রস্ত হয়ে চীনে যাত্রাপথে নদীতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। যাইহোক, তাকে উদ্ধার করা হয় এবং একটি পরিবার তাকে সুস্থ করে তোলে যারা পরবর্তীতে তাকে দত্তক নেয়। অনেক বছর পরে তিনি উইসাং এর সাথে তার চীন ভ্রমণে দেখা করেছিলেন কিন্তু তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে তিনি এখন একজন সন্ন্যাসী এবং তার ইচ্ছামতো সিলায় তার সাথে ফিরে যেতে পারবেন না। তবে, তিনি বলেছিলেন যে চীনে তার পড়াশোনা শেষ হলে তিনি তাকে দেখতে যাবেন। দশ বছর পর তিনি এই কাজ করলেন। দুর্ভাগ্যবশত, মায়ো হাওয়া বাড়িতে ছিলেন না তাই উইস্যাং তার কাছে একটি নোট রেখে যান এবং তার জাহাজটি সিলায় ফেরত আনার জন্য তাড়াহুড়ো করেন। মিও হাওয়া বাড়িতে ফিরে এসে বুঝতে পেরেছিল যে মাস্টার উইস্যাং তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি কিছুটা ব্যাকুল হয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন তাকে দেখতে পারবেন বলে। তিনি যখন বন্দরে পৌঁছাইলেন, জাহাজটি ততোক্ষনে তীর থেকে বেশ দূরে চলে গিয়েছে এবং তিনি হতাশ হয়ে পানিতে লাফিয়ে পড়েন। কথিত আছে, তিনি পানিতে পড়ার সাথে সাথে ভালবাসার শক্তিতে জাদুকরী ড্রাগনে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। এর পরের বিস্তারিত ইতিহাস আমার জানা নেই। নিচের ছবিতে এই কাহিনীর কিছুটা সততা পাওয়া যায়।

yeongju Confucian Academy


৮) রাতের খাবার: আমাদের জন্য রাতে ট্রাডিশনাল কোরিয়ান খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। খাদ্য তালিকায় একটি সামুদ্রিক মাছের ফ্রাই দেওয়া হয়েছিল যার স্বাধ অনেকদিন মনে থাকবে।

yeongju Confucian Academy


৯) রাতের সংগীত পরিবেশনা: কোরিয়ানরা শিল্প ও সংস্কৃতির ধারক বাহক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের জন্য ১ ঘন্টার একটি সংগীত সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছিল যা অত্যন্ত মনোমুগ্ধ্যকর।

yeongju Confucian Academy


১০) আপেল বাগান পরিদর্শন: বলে রাখা ভালো, এই শহরটিকে আপেল শহর বললে কোনো ক্রমেই ভুল হবে না। আমি কয়েটি আপেল বাগান ভালোমতো ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি।

yeongju Confucian Academy


১১) Sosuseowon Confucian Academy ভ্রমণ: আপেল বাগান ঘুরে এসে সকালের নাস্তা করে Sosuseowon কানফুসিয়ান একাডেমী দেখতে গিয়েছিলাম। এই একাডেমিটি বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত। এর পাশেই রয়েছে গ্রাম।

yeongju Confucian Academy


yeongju Confucian Academy


yeongju Confucian Academy


১২) Yeongju Seobbichon গ্রাম: Neo-Confucianism এর যিনি প্রতিষ্ঠাতা, তিনি এই গ্রামটি প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন। জোসেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জেওং ডো-জেওন এর জন্মস্থান হলো এই গ্রামে। এতো বছর পূর্বের প্রতিষ্ঠিত এই গ্রামটিকে না দেখলে বুঝাই যেতোনা যে কোরিয়ান গ্রাম্য সমাজ কত উন্নত ছিল। যাইহোক, আমরা সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখলাম।



১৩) হ্যাশ ট্যাগ এবং আমাদের গাইড: এই ভ্রমণে আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল যে সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের ৫ টি উল্লেখযোগ্য স্থানের ছবি সহ পোস্ট দিতে হবে। যদিও আমি দিতে পারি নাই, তবে আমি যেহেতু ব্লগ লিখবো সেহেতু আমাকেও দারুন একটি গিফট দেওয়া হয়েছিল।

yeongju Confucian Academy


১৪) আমাদের ট্রান্সলেটর: উজবেকিস্তান থেকে আগত মিস লাজ্জাত ছিলেন আমাদের ট্রান্সলেটর যিনি কোরিয়াতে পড়াশোনা করছেন এবং আমাদেরকে সুন্দর ভাবে প্রতিটা স্থান চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

yeongju Confucian Academy


১৫) আমার সাথে আরো যারা ছিলেন: নেদারল্যান্ডস, সাউথ আফ্রিকা, রাশিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাকস্থান, ইরান, মিশর, ও মায়ানমার থেকে আগত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং চাকুরীজীবি। সবার সাথে দারুন মজার সময় কেটেছে। পরের দিন সন্ধ্যায় আমরা সোল্ ফিরে আসি।

yeongju Confucian Academy






[এই আর্টিকেলটি কপি বা শেয়ার করার ক্ষেত্রে আমার এই সোর্সকে মেনশন করার জন্য অনুরুধ করা হলো। ]

[ রেফারেন্স: জুলহাস সুজনের ব্যাক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে - www.julhas.com/travelling/yeongju-buseoksa-temple ]